পর্দায় মা হয়ে কাঁদাতেন, এখনো কাঁদেন অভিভাবকহীন রেহানা জলি (2025)

সালটা ১৯৮৫, রেহানা জলির বয়স তখন ১৬। ওই বয়সে অভিনয়ে আসা। ‘মা ও ছেলে’ নামে ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে রুপালি পর্দায় যাত্রা শুরু। সময়ের হিসাবে পেরিয়ে গেছে ৪০ বছর। মায়ের চরিত্রে অভিনয় করতে করতে এতটাই বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠেছিলেন, যেখানেই যেতেন, সবাই মা বলেই ডাকতেন। হয়ে ওঠেন সিনেমার মা। এর মধ্যে চার বছর ধরে অসুস্থতার কারণে অভিনয়ের বাইরে। যে মানুষটি অভিনয়ে হাসিয়েছেন, কাঁদিয়েছেন, তাঁর জীবনটাই এখন ভীষণ কষ্টের। তিনি শুধুই কাঁদেন, তবে তাঁর এই কান্না এখন পর্দায় দেখা যায় না। ঘরের চারদেয়াল সেই কান্নার সাক্ষী। কখনো শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদেন। কখনো এই কান্নার সাক্ষী তাঁরই মেজ বোন। চার বছর ধরে এমনই জীবনযাপন অভিনয়শিল্পী রেহানা জলির।

মা হয়ে সিনেমার পর্দায় কত নায়ক-নায়িকা, সন্তানকে যে রেহানা জলি আগলে রাখতেন, তার হিসাব নেই। বাংলা সিনেমা দেখেছেন, এমন কোনো দর্শক খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে, যাঁরা অভিনয়শিল্পী রেহানা জলিকে চেনেন না। সিনেমায় তাঁর দুঃখকষ্টে কাতর হননি, এমন মানুষ কমই আছেন।

৪০ বছরের অভিনয়জীবনে এসে রেহানা জলি যে গল্প শোনালেন, তা সিনেমাকেও হার মানায়। প্রচণ্ড অসুস্থ তিনি। সাত বছর আগে ফুসফুসের ক্যানসার আক্রান্ত করে তাঁকে। এখন স্নায়ুর সমস্যায় দিন পার করছেন। ভীষণ কষ্টে আছেন তিনি। অসুস্থতার কারণে অভিনয় করতে পারছেন না প্রায় চার বছর। চিকিৎসকের নির্দেশনা মেনে বোনের ইস্কাটনের গাউসনগরের বাসায় থেকে চিকিৎসা করাচ্ছেন রেহানা জলি। কিন্তু তিনি বড় একা। তিন যুগের বেশি সময় যে চলচ্চিত্র পরিবারের বাসিন্দা ছিলেন, এখন সেখান থেকে কেউ তাঁর খবর আর নেন না। প্রথম আলোর সঙ্গে আজ রোববার সকালে কথা বলার সময় বারবার নিজের কান্না চেপে রাখার চেষ্টা করেও পারছিলেন না।

রেহানা জলি জানালেন, তাঁকে চিকিৎসকের কাছে যেতে হয়। যে মেজ বোন লাইজুর বাসায় তিনি থাকেন, সেই বোনের দুটি কিডনি নষ্ট। তাঁকে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতে হয়। স্বামী-সন্তান কেউ নেই সেই বোনের।

রেহানা জলি বলেন, ‘আমার এখন নার্ভে সমস্যা। বসলে উঠতে পারি না। আরও রয়েছে নানা জটিলতা। সব মিলিয়ে মানসিক অশান্তিতে আছি। এককালে আমি সংসার চালাতাম। একটা সময় পর আমার যে বোনটা সবকিছু করত, তারই দুইটা কিডনি নষ্ট। ভাগ্যের কী লীলাখেলা।’

প্রথম যখন রেহানা জলি সিনেমায় অভিনয় করেন, তখন তিনি গেন্ডারিয়ার মনিজা রহমান গার্লস স্কুলের ক্লাস নাইনের ছাত্রী। ঠিক সে সময়টাতে কামাল আহমেদ পরিচালিত ‘মা ও ছেলে’ ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ পেয়ে যান। প্রথম সিনেমায় বুলবুল আহমেদের স্ত্রী এবং চিত্রনায়ক আলমগীরের মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেন। অভিনয় দিয়ে প্রথম সিনেমায় প্রশংসা কুড়ান। অর্জন করে নেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেত্রীর সম্মাননা। এরপর তাঁর অভিনয়ের ট্রেন আর থামেনি। চালিয়ে গেছেন পড়াশোনাও। ডিগ্রিতে ভর্তি হলেও চূড়ান্ত পর্বের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারেননি। শুরুর দিকে ৪০টির মতো ছবিতে নায়িকা ও কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন রেহানা জলি। খুব অল্প সময়ে চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে নিজের আলাদা অবস্থান তৈরি করে নেন।

রেহানা জলি মা হিসেবে অভিনয় করেছেন আলমগীর, রাজ্জাক, ইলিয়াস কাঞ্চন, ওমর সানী, মান্না, সালমান শাহ, মৌসুমী, শাবনূর, পপি, শাকিব খান, সাইমন ও বাপ্পীর। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি শাকিব খানের মা হিসেবে অভিনয় করেছেন। শুধু মা চরিত্রে নয়, শুরুর দিকে ৪০টির মতো সিনেমায় নায়িকাও হয়েছেন রেহানা জলি। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘প্রেম প্রতিঘাত’, ‘পাপের প্রায়শ্চিত্ত’, ‘নিষ্পাপ’, ‘মহারানী’, ‘গোলমাল’ ও ‘চেতনা’।

সাত-আট বছর ধরে বোন লাইজুর সঙ্গে ইস্কাটনের গাউসনগর এলাকায় আছেন রেহানা জলি। তিন যুগের বেশি সময় যেসব সহকর্মীর সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের নীরবতায় কষ্ট পেয়েছেন রেহানা জলি। তিনি বলেন, ‘আমার পুরো জীবনই কেটেছে অভিনয়ে। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত শুটিং করে গেছি। দেশের নামকরা সব নায়ক-নায়িকার মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছি। অথচ গত চার বছরে কেউ একবারের জন্যও আমার খোঁজ নিল না। কেউ একজন তো ফোন করে অন্তত জিজ্ঞেস করতে পারত, জলি আপা, কেমন আছেন! অসুস্থ হয়ে মানুষ চিনতে পারছি। তবে এই সময়টায় শিল্পী সমিতির ভোটের সময় কয়েকজন খোঁজ নিয়েছে, এর বাইরে একবারের জন্যও কেউ এখন পর্যন্ত কোনো খবর নেয়নি।’

রেহানা জলি এ-ও বলেন, ‘আমার বোনেরা ছিল বিধায় বেঁচে আছি। ওরা যদি না থাকত, আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াতাম! চিকিৎসা ভালোভাবে হলে আমি আবার কাজে ফিরব। ভারতের অনেক শিল্পী আছেন রোগ নিয়েও কাজ করেন। আমার আগে সঠিক চিকিৎসা দরকার। টাকাপয়সা, সবকিছু দিয়ে বোনেরা আমাকে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু কয়েক বছর ধরে অনেক খরচ হয়েছে। ওদের আর কষ্ট দিতে ইচ্ছা করছে না। ফুসফুসের ক্যানসারের চিকিৎসায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকা পেয়েছিলাম। সেই টাকায় চিকিৎসা করেছি। ফুসফুস ও হাড়ের চিকিৎসায় তখন মাসে ৩০-৪০ আবার কখনো ৫০ হাজার টাকা খরচ হতো। এরপর আরও নানান জটিলতায় চিকিৎসা করাতে হয়েছে। কাজ না থাকায় এ সময় ঋণও করতে হয়েছে। কয়েক বছর ধরে নার্ভের সমস্যাও চলছে। আমি পুরোপুরি সুস্থ হলে অভিনয়ে ফিরতে চাই।’

অভিনয়শিল্পী রেহানা জলির বাবা ছোটবেলায় মারা যান। মা মারা যান আট বছর আগে। পাঁচ বোন আর এক ভাইয়ের মধ্যে রেহানা জলি সবার বড়। ছোটবেলা থেকেই তাঁর অভিনয়ের আয় দিয়ে পাঁচ বোন ও এক ভাইকে গড়ে তুলেছেন। সবাইকে উচ্চশিক্ষিত করিয়েছেন বলেও জানালেন। তবে একমাত্র ভাই ২৫ বছর বয়সে মারা যান। এখন শুধু পাঁচ বোন বেঁচে আছেন। এর মধ্যে যে বোনের সঙ্গে রেহানা জলি থাকেন, তাঁরও দুটি কিডনি পুরোপুরি বিকল।

রেহানা জলি বললেন, ‘পরিবারের সবার মধ্যে আমি বড়। আমি অল্প বয়সে অভিনয় শুরু করি। এর পর থেকে পরিবারের দায়িত্ব নিই। সংসারের কথা ভেবে বিয়েও করিনি। কোনো ধরনের সম্পর্কেও নিজেকে জড়াইনি। আমার ভাই-বোনদের ঠিকঠাক গড়ে তোলাটাই ছিল আমার লক্ষ্য। বোনেরা সবাই উচ্চশিক্ষিত। মা ছিলেন, সেই মা আট বছর আগে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন! ভাইটাও নেই। বাবা তো সেই ছোটবেলায় মারা গেছেন। আমার জীবনটাই এখন অন্য রকম। আমার লাইফস্টাইলের গল্প শুনলে যে কারও খারাপ লাগবে। আমি এখন কোথায় যাব, কী করব? আমরা পাঁচ বোন অভিভাবকহীন।’

রেহানা জলি জানালেন, চার বছর আগে তাঁর অভিনীত ছবির তালিকায় আছে ‘ইস্টিশন’, ‘মন পিঞ্জর’। এরপর আর কোনো নতুন ছবির কাজ করেননি।

কথা প্রসঙ্গে রেহানা জলি বললেন, ‘এককালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক সময় দিয়েছি। বলা যায়, ২৪ ঘণ্টা সময় দিয়েছি। আমি ব্যস্ত মা ছিলাম। অনেক ব্যস্ত। এখন মরলাম কি বাঁচলাম, কেউই কোনো খবর নেয় না। ভোট এলে তখন খোঁজখবর নেয়, এর বাইরে কারও কোনো খবর নেই।’

অভিনয়জীবনটাকে পেছনে ফিরে দেখার চেষ্টা করছিলেন রেহানা জলি। তিনি বলেন, ‘কী করলাম জীবনে। চার শ ছবিতে অভিনয় করেছি। সবকিছুই কি তাহলে মিথ্যা! সবই অভিনয়। এই জগতে দেখছি কেউ কারও নয়। এ কেমন জীবন আমাদের। এমন জীবন তো চাইনি।’

পর্দায় মা হয়ে কাঁদাতেন, এখনো কাঁদেন অভিভাবকহীন রেহানা জলি (2025)

References

Top Articles
Latest Posts
Recommended Articles
Article information

Author: Carlyn Walter

Last Updated:

Views: 6269

Rating: 5 / 5 (70 voted)

Reviews: 85% of readers found this page helpful

Author information

Name: Carlyn Walter

Birthday: 1996-01-03

Address: Suite 452 40815 Denyse Extensions, Sengermouth, OR 42374

Phone: +8501809515404

Job: Manufacturing Technician

Hobby: Table tennis, Archery, Vacation, Metal detecting, Yo-yoing, Crocheting, Creative writing

Introduction: My name is Carlyn Walter, I am a lively, glamorous, healthy, clean, powerful, calm, combative person who loves writing and wants to share my knowledge and understanding with you.